পরিবেশ রক্ষায় আমাদের করণীয়
বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে জীবের অস্তিত্ব আছে। আর এই জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পৃথিবীর এই পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম।আমাদের চারপাশে বিদ্যমান সকল উপাদান নিয়েই পরিবেশ গড়ে উঠেছে।
মাটি, পানি, প্রাণী, উদ্ভিত, বায়ু ইত্যাদি এই সবই পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত।তবে পরিবেশের প্রধান উপাদান হিসেবে মাটি , পানি ও বায়ু - এ তিনটিকে বিবেচনা করা হয়। পরিবেশ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ "enites" শব্দ থেকে। বাংলায় "পরী" ও "আবরণ" এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে "পরিবেশ" শব্দটি গঠিত হয়েছে। আমাদের চারপাশে বিদ্যমান সকল ধরনের পদার্থকে "পরী" বলা হয়। আর "আবরণ" মানে হলো কোনো কিছুকে ঘিরে থাকা বা আচ্ছাদন করে থাকা ।
পরিবেশ দূষণ
পানি দূষণ
পানি দূষণের কিছু কারণ হলো
- নদী বা সমুদ্রের পাশে রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা বা বড় ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপনের ফলে কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ পানির সাথে মিশে পানি দূষণ ঘটছে।
- পুকুর বা নদীর পাশে টয়লেট স্থাপনের ফলে টয়লেটের বর্জ্যসমূহ পানির সাথে মিশে পানি দূষিত হচ্ছে।
- অতিরিক্ত ভূমিক্ষয় পানি দূষণের অন্যতম কারণ।
- কৃষি জমিতে অধিকহারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত হচ্ছে।
- আধিক বৃষ্টির ফলেও পানি দূষণ হয়ে থাকে।
পানি দূষণের প্রভাব
পানি দূষণ রোধে করণীয়
- নদীর তীরে শিল্পকারখানাগুলোর ব্যবহার কমাতে হবে। শিল্পকারখানা গুলোর আবর্জনা পানিতে ফেলা যাবে না এবং নিয়মিত এসব আবর্জনা এক্ষণে করো করে না রেখে প্রতিনিয়ত পরিষ্কারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
- কোনো জিনিসের সদ্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে এবং ভূ-উপরস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- গৃহস্থালির বর্জ্য পদার্থ,মালবাহী জাহাজের তেল ইত্যাদি এসব পানিতে মিশ্রিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে।
- পুকুর বা পানির উৎস হতে কাছাকাছি স্থানে টয়লেট স্থাপন করা যাবে না।
- পুকুর বা নদীর পানিতে গবাদিপশুর গোসল করানো, কাপড় কাচা থেকে বিরত থাকতে হবে।
মাটি দূষণ
- কৃষি জমিতে অধিক হারে সার প্রয়োগের ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। ফলে মাটি দূষিত হয়।
- কৃষি জমিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে মাটি ক্ষয় হয়।
- এসিড বৃষ্টির ফলে মাটির উর্বরতা কমে যায়।
- শিল্পকারখানার বর্জ্য পদার্থ মাটিতে ফেলার ফলে মাটি দূষিত হয়।
- গৃহস্থালির বর্জ্য পদার্থ যেখানে সেখানে ফেলার ফলে মাটি দূষিত হয়।
- প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ মাটিতে ফেলার ফলে মাটি দূষণ সংঘটিত হয় ।
- বিভিন্ন খনি হতে খনিজ পদার্থ আহরণের সময় অধিক পরিমাণ অঞ্চল খনন করে মাটি সরিয়ে ফেলতে হয়। এর ফলে বিপুল পরিমাণ অঞ্চলের ফসলহানি হয় এবং মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়।
- বিভিন্ন পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে মাটি ক্ষয় হয়।আর উক্ত স্থানে অনেকদিন পর্যন্ত উক্ত পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট রেডিয়েশন থেকে যায়।
মাটি দূষণের প্রভাব
মাটিতে অপচিত পদার্থ ফেলার কারণে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। কিছু পদার্থ রয়েছে যেগুলো মাটিতে ফেললে পচতে অনেক দিন সময় লাগে আর এর উপস্থিতির কারণে গাছের বৃদ্ধি বাধা পায়। এসিড বৃষ্টির ফলে মাটিতে বিদ্যমান অণুজীব মারা যায় ফলে মাটি ক্ষয় হয়। মাটিতে বিদ্যমান অণুজীব মারা গেলে কোনো জীবের দেহ পচতে অনেক সময় লাগে। তেজস্ক্রিয় পদার্থ গুলোর দ্বারা সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তা দ্বারা মাটির বিপুল পরিমাণ দূষণ সাধিত হয়। তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহ ফলাফল আমরা এখনো দেখতে পাই জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে।
মাটি দূষণ রোধে করণীয়
- জমিতে পরিমিত পরিমাণে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- প্রয়োজনের অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করা যাবে না।
- যেসকল পদার্থ মাটিতে পচে না সেসকল পদার্থ মাটিতে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- তেজস্ক্রিয়তা থেকে ফসলের জমিকে তুলনামূলক দূরে রাখতে হবে।প্রয়োজনে ফসলি জমিকে কলকারখানা থেকে এমন দূরত্বে রাখতে হবে যেন তেজস্ক্রিয়তার কোনো প্রভাব এর উপর না পরে।
- গবাদিপশু সহ অন্যান্য প্রাণীর মৃতদেহকে মাটির উপরে না পুতে মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে।
- যেকোনো সামগ্রীর পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- এছাড়াও আমাদের দেশের আইনের যথাযত প্রায়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বায়ু দূষণ
বায়ু দূষণের কিছু কারণ
- বিভিন্ন বৈদ্যুতিক উৎপাদন কেন্দ্রে জীবস্ম জ্বালানী পড়ানোর ফলে ক্ষতিকর কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। এর ফলে বায়ু দূষণ ঘটে।
- তেল ও গ্যাসের কারখানা থেকে অনেকসময় মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই মিথেন গ্যাস বায়ু দূষণে ভূমিকা রাখে ।
- বায়োমাস অর্থাৎ কাঠ, ফসলের বর্জ্য ও গোবর পড়ানোর মাধ্যমে বায়ু দূষণ ঘটে। এর দুষকগুলোর মধ্যে রয়েছে পলিসাইক্লিক আরোমেটিক হাইড্রোকার্বন যা বায়ু দূষণ ঘটায়।
- বিভিন্ন যানবহন ও কলকারখানায় উৎপন্ন ধোয়া থেকে বায়ু দূষিত হয়।
- আরোসল স্প্রে, চুলের স্প্রে সহ আরও অন্যান্য ঊর্ধপাতীত দ্রাবক পদার্থ থেকে উৎপন্ন ক্ষতিকর ধোয়া থেকে বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।
- জীবের ফসিল থেকে উৎপন্ন গ্যাস থেকেও বায়ু দূষিত হয়।
বায়ু দূষণ প্রভাব
বায়ু দূষনের ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের চারপাশে লক্ষ্য করা যায়। বায়ু দূষনের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তর ফুটো হয়ে ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি বায়ু মন্ডল ফেড করে ভূপৃষ্ঠে প্রবেশ করছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের শরীরে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বায়ু দূষনের ফলে ভাইরাস ও জীবাণু বায়ু মাধ্যমেও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
এর ফলে যেকোনো রোগ বর্তমানে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বায়ু দূষনের ফলে শ্বাসনালীর সংক্রমণ, ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ সহ আরও বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হতে পারে। বহিঃস্থ বায়ু দূষনের ফলে বছরে প্রায় ৩.৬১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে। বায়ু দূষনের ফলে বাতাসে গ্যাসীয় ভারসাম্য বজায় থাকে না। ফলে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এককথায় মানবজীবনে বায়ু দূষনের প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়।
বায়ু দূষণ রোধে করণীয়
- জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- বায়ু দূষণ ঘটায় এমন যানবাহনের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।
- বায়মাসের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।
- যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলে রাখা যাবে না।কারণ আবর্জনা পচে বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন করে।
- বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে।কোথায় আছে , গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান।
পরিবেশের গুরুত্ব
জীবের বেছে থাকার জন্য পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম।আমাদের চারপাশে বিদ্যমান সকল ধরনের উপাদানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।নির্দিষ্ট পরিবেশ ব্যতীত কোনো জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।জীবের খাদ্যাভাব পূরণের জন্য যেমন পরিবেশ প্রয়োজন তেমনি নিরাপত্তার জন্যও পরিবেশের দরকার।প্রাণীর বেছে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অক্সিজেন উদ্ভিদ আমাদের দিয়ে থাকে।আবার উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস প্রাণী নিশ্বাস ত্যাগের সময় বাতাসে ছেড়ে দেয়।
এইভাবে পরিবেশের প্রতিটি প্রাণীর উপর উদ্ভিদ এবং প্রতিটি উদ্ভিদের উপর প্রাণী নির্ভরশীল। এই পরিবেশ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদান সরবরাহ করে। পরিবেশের প্রয়োজনীয় বলে শেষ করার মতো না। তাই এই পরিবেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য সকলেরই এগিয়ে আসা দরকার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। দিন শেষে মানুষকেই এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাই সকলের উচিত পরিবেশকে দূষণের হ্যাঁ থেকে রক্ষা করে রাখতে।
এই পরিবেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্যই ক্ষতির মুখে পতিত হচ্ছে। আর পরিবেশের উপাদান আমরা নিজেও। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইলে পরিবেশ রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়াও সরকার কতৃক গাছ লাগানোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা উচিত। তবে আমাদের দেশে এসকল কর্মকাণ্ডে কোনো মানুষই যোগদান করতে আগ্রহী থাকে না।
আমরা সবাই যদি সকলের নিজ নিজ জায়গা থেকে চেষ্টা করি তাহলে ইনশাল্লাহ আমরা সফল হবো এবং সকলে মিলে যদি এইসব পরিবেশ উন্নয়মূলক কর্মসূচিতে যোগদান করে ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে পরিবেশ রক্ষা অনেকাংশে সার্থক হবে। আমাদের দেশের বিরত জনসংখ্যা পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় কারন। আর এই পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য তাই জনগণকেই এগিয়ে আস্তে হবে। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url